শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৪

Hajir najir bye kazi bhai

মোল্লা আলী কারীর বক্তব্য সম্পর্কে এক দেওবন্দীর মিথ্যা দাবি

সম্প্রতি জনৈক দেওবন্দী লেখক এক আজব দাবি উত্থাপন করেছে যে মোল্লা আলী কারী তাঁর ‘শরহে শেফা’ গ্রন্থে নাকি আসলে বলেছিলেন, “মহানবী (দ:)-এর রুহ (মোবারক) মুসলমানদের ঘরে উপস্থিত নন ” (লা আন্না রুহাহু হাযিরাতুন ফী বুইউতিল্ মুসলিমীন), যা মোল্লা কারীর বক্তব্যের ঠিক উল্টো! ওই দেওবন্দী বলে:

”তিনি (মোল্লা আলী কারী) এই বিষয়ে তাঁর ‘শরহে শেফা’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন যে লা আন্না রুহাহু হাযিরাতুন ফী বুইউতিল মুসলিমীন - অর্থাৎ, মহানবী (দ:)-এর রূহ (মোবারক) মুসলমানদের ঘরে উপস্থিত মর্মে ধারণাটি ভুল। কিছু কিছু সংস্করণে (আরবী) 'লা' শব্দটি বাদ পড়ায় কোনো কারণ ছাড়াই কতিপয় ব্যক্তির মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে; এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব (’জাআল হক্ক’ ১৪২ পৃষ্ঠা দেখুন)।.....মোল্লা আলী কারী স্বয়ং তাঁর সকল সুস্পষ্ট উদ্ধৃতিতে হাযের ও নাযেরের ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছেন। যারা তাঁর সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট (অপ্রাসঙ্গিক) উদ্ধৃতিগুলোর ওপর নির্ভর করেন, তাঁরা সম্পূর্ণ ও নিশ্চিতভাবে ভ্রান্ত।” [নোট-১৫: সারফরাজ সাফদার কৃত ‘আঁখো কি দানদাক’ (পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৮)।]

ওপরের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবি কেউ তখনি উত্থাপন করতে পারে, যখন আরবী ভাষাগত জ্ঞানে সে মূর্খ হয়। কেননা, মোল্লা আলী কারী তাঁর বক্তব্য আরম্ভ করেন আরবী শব্দ ‘আয়’ (অর্থাৎ/মানে) দ্বারা, যার সাথে না-বাচক (নফি-সূচক) বাক্য জুড়ে দেয়া আরবী ব্যাকরণগত ভুল হবে; যেমন - ‘মহানবী (দ:)-এর রূহ মোবারক মুসলমানদের ঘরে উপস্থিত নন।’ সত্য হলো, আরবী ‘লা’শব্দটি বাদ পড়ে নি, কারণ তা প্রথমাবস্থায় সেখানে ছিলই না; আর তা ওখানে ছিল মর্মে দাবি করাটা তাহরিফ তথা দলিল রদ-বদলের অপচেষ্টার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অধিকন্তু, মোল্লা আলী কারী ’উপস্থিত’ বোঝাতে যে (আরবী) শব্দ ‘হাযির’ ব্যবহার করেছেন, তা পুং-লিঙ্গে (মোযাক্কের); ‘হাযিরাতুন’ তথা স্ত্রী-লিঙ্গে (মোয়ান্নেস) নয়। কেননা, রুহের ক্ষেত্রে উভয় লিঙ্গ ব্যবহৃত হলেও মহানবী (দ:)-কে উদ্দেশ্য করার সময় মোযাক্কের ব্যবহার করা অধিক যথাযথ।

এক দেওবন্দী কর্তৃক নবুয়্যতের গুণাবলী অস্বীকার

দেওবন্দীদের অপর এক ব্যক্তি যাকে কেউ কেউ ’আলেম’ মনে করেন, সে হুযূর পাক (দ:)-এর প্রতি হাযের ও নাযের হওয়ার বৈশিষ্ট্য আরোপ করার বেলায় আপত্তি উত্থাপন করেছিল; কেননা তার দাবি অনুযায়ী এই বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী একমাত্র আল্লাহতা’লারই অধিকারে। তর্কের ভিত্তি হিসেবে যদি এই কথাকে সত্য হিসেবে ধরেও নেয়া হয়, তথাপি যুক্তি ভুল। কেননা, এ কথা এই রকম শোনায় যে ‘আর্ রউফ’ ও ‘আর-রাহীম’ খোদায়ী গুণাবলী হবার কারণে সেগুলো নবুয়্যতের গুণাবলী হতে পারে না। ইমাম কাজী আয়ায (রহ:) তাঁর ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থে এই কূটতর্ককে খণ্ডন করেছেন এ কথা বলে:

”জেনে রেখো, আল্লাহ তাঁর আম্বিয়া (আ:)-দের অনেকের প্রতি সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ তাঁর নিজের কিছু নাম মোবারক তাঁদেরকে দান করেছেন; উদাহরণস্বরূপ, তিনি হযরত এসহাক (আ:) ও হযরত ইসমাইল (আ:)-কে ‘আলিম’ (জ্ঞানী) ও ‘হালিম’(ধৈর্যশীল) নামে ডেকেছেন। ঠিক তেমনি হযরত ইবরাহীম (আ:)-কে ‘হালিম’, হযরত নূহ (আ:)-কে ‘শাকুর’ (কৃতজ্ঞ), হযরত মূসা (আ:)-কে ’কারীম’ (মহৎ) ও ‘ক্কাওয়ী’ (শক্তিশালী), হযরত ইউসুফ (আ:)-কে ‘হাফেয,’ ‘আলেম’ (জ্ঞানী অভিভাবক/রক্ষক), হযরত আইয়ুব (আ:)-কে ‘সাবুর’(ধৈর্যবান), হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত এয়াহইয়া (আ:)-কে ’বারর’ (আত্মোৎসর্গিত), এবং হযরত ইসমাইল (আ:)-কে ‘সাদিক আল-ওয়াদ’আ’ (প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী) নামে ডেকেছেন.....তথাপি তিনি আমাদের মহানবী (দ:)-কে বেছে নিয়েছেন (এঁদের মধ্যে) এই কারণে যে, তাঁরই মহাগ্রন্থে (আল-কুরআনে) এবং আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের পবিত্র জবানে বিবৃত তাঁর (বহু) নাম মোবারকের অঢেল সম্পদ তিনি মহানবী (দ:)-কে মন্ঞ্জুর করেছেন।” [নোট-১৬: ইমাম কাজী আয়ায প্রণীত ‘শেফা শরীফ’; ইংরেজি অনুবাদ - আয়েশা আবদ আর-রাহমান বিউলী (গ্রানাডা, মদীনা প্রেস, ১৯৯২), পৃষ্ঠা ১২৬।]

ওপরে উদ্ধৃত প্রমাণাদি সন্দেহাতীতভাবে পরিস্ফুট করে যে ’হাযের’ ও ’নাযের’ নাম দুটো আল্লাহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যদি হয়ও, তথাপি তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে ওই বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী সন্নিবেশিত থাকার সম্ভাবনায় কোনো রকম বাধা নেই। বস্তুতঃ এই বিষয়টি সর্বজন-জ্ঞাত যে কেরামন কাতেবীন তথা কাঁধের দুই ফেরেশতা, ‘কারিন’, যমদূত আযরাঈল ফেরেশতা এবং শয়তানও উপস্থিত; এরা সবাই দেখছে, শুনছে, আর সুনির্দিষ্ট যে কোনো সময়ে সংঘটিত মানুষের সকল কর্মের সাক্ষ্য বহন করছে।

উপরন্তু, ‘হাযের’ ও ’নাযের’ কি খোদায়ী (ঐশী) নাম ও গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত? ইমাম আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (মোজাদ্দেদে আলফে সানী)-কে এ মর্মে উদ্ধৃত করা হয় যে তিনি বলেছিলেন: “আল্লাহতা’লা প্রতিটি ও সকল ছোট ও বড় ঘটনা/পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং তিনি ’হাযের’ ও ’নাযের’। তাঁর সামনে প্রত্যেকের শরমিন্দা হওয়া উচিত।” [নোট-১৭: ‘মকতুবাত-এ-ইমাম-এ-রব্বানী, ১ম খন্ড, জব্বারী খানকে লেখা ৭৮ নং চিঠি।]

তবে খোদায়ী বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী আজ্ঞাস্বরূপ এবং অনুমানেরও অতীত। যুক্তি-তর্ক, সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো কিছুর সাথে তুলনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কিংবা অন্য কোনো রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ঐশী বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী উপলব্ধির কাজে ব্যবহার করা হয় না, বরং শরীয়তের মৌলিক দুটো উৎস কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে প্রকাশিত ঐশী প্রত্যাদেশই শুধু এ কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমস্ত না হলেও বেশির ভাগ আকিদার কেতাবে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আল-মাতুরিদীর আকায়েদ, তাতে এই মৌলিক বিশ্বাসটি উপস্থিত রয়েছে। অতএব, আমরা ‘আল-হাযের’ সম্পর্কে কথা বলতে পারবো না, যখন ‘আল-নাযের’ ‘আশ্ শাহীদের’-ই অনুরূপ, যা’তে ঐশী দৃষ্টিক্ষমতার মানে হলো খোদাতা’লার জ্ঞান। ইমাম বায়হাকী বলেন:

”আশ-শাহীদ তথা সাক্ষীর অর্থ সেই মহান সত্তা (খোদা) যিনি ভালভাবে জ্ঞাত যে সকল সৃষ্টি উপস্থিত থাকা অবস্থায় সাক্ষ্যের মাধ্যমে জানতে সক্ষম.......কেননা, দূরে অবস্থানকারী কোনো মানুষ তার ইন্দ্রিয়গুলোর সীমাবদ্ধতায় ভোগে; পক্ষান্তরে, আল্লাহতা’লা ইন্দ্রিয়ের মুখাপেক্ষী নন এবং তিনি এর অধিকারী মানুষের মতো সীমাবদ্ধও নন।” [নোট-১৯: আল-বায়হাকী কৃত ‘আল-আসমা’ ওয়াস্ সিফাত’ (কাওসারী সংস্করণের ৪৬-৪৭ পৃষ্ঠা; হাশিদী সংস্করণের ১:১২৬-১২৭)।] {‘শাহীদ’ আল-কুরআনে বর্ণিত নবুয়্যতের একটি বৈশিষ্ট্যও}

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন