শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৪

Hajir najir bye kazi bhai

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[আমার পীর ও মুরশীদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত]

এবং জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন” (সূরা হুজুরাত, ০৭)। [নোট-১: হাজের-নাজের-বিষয়ক এই সংযোজনী শায়খ হিশাম কাব্বানী কৃত Encyclopedia of Islamic Doctrine-এর ৩য় খণ্ডের ”মহানবী (দ:)-এর অদৃশ্য জ্ঞান” শীর্ষক অনুচ্ছেদে উপস্থাপিত বক্তব্যের সম্পূরণ।]
  
”আর তারা পায় না তাঁর (ঐশী) জ্ঞান থেকে, কিন্তু যতোটুকু তিনি ইচ্ছা বা মর্জি করেন” (সূরা বাকারা, ২৫৫)।

”অদৃশ্যের জ্ঞাতা (আল্লাহ), সুতরাং আপন অদৃশ্যের ওপর কাউকে ক্ষমতাবান করেন না (কেবল) আপন মনোনীত রাসূলবৃন্দ (আ:) ব্যতিরেকে” (সূরা জ্বিন, ২৬-৭)।

”এবং মহানবী (দ:) অদৃশ্য বিষয় বর্ণনা করার ব্যাপারে কৃপণ নন” (সূরা তাকভীর, ২৪)। [ইমাম আহমদ রেযা খানের প্রণীত ‘তাফসীরে কানযুল ঈমান’ হতে গৃহীত অনুবাদ]

ইবনে খাফিফ আশ-শিরাযী তাঁর ‘আল-আকিদা আস্ সহিহা’ (৪৮ পৃ:) গ্রন্থে বলেন:

”রাসূলুল্লাহ (দ:) যা (এ যাবত) ঘটেছে এবং যা ঘটবে সে সম্পর্কে জ্ঞানী, আর তিনি গায়বের তথা অদৃশ্যের খবর দিয়েছেন” (ওয়া [ইয়া’তাকিদু] আন্নাহুল-আ’লিমু বি-মা কানা ওয়া মা ইয়াকুনু ওয়া আখবারা ’আন্ ইলমিল গায়ব)

মানে হলো, আল্লাহ তাঁকে যা কিছু জানিয়েছেন তা জানার অর্থে। আমাদের শিক্ষক মহান ফকীহ শায়খ আদিব কাল্লাস বলেন: “লক্ষ্য করুন, ইবনে খাফিফ এ কথা বলেন নি ’তিনি (এ যাবত) যা ঘটেছে এবং যা ঘটবে সবই জানেন।”

শায়খ আবদুল হাদী খারসা আমাদের জানান:

রাসূলে পাক (দ:) সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন এবং সৃষ্টিজগতকে সেভাবে জানেন যেমনভাবে কোনো কক্ষে উপবেশনকারী ব্যক্তি ওই কক্ষ সম্পর্কে জানেন। কোনো কিছুই তাঁর থেকে গোপন নয়। কুরআন মজীদের দুটো আয়াত একে সমর্থন দেয়; ১মটি এরশাদ ফরমায় - “তবে কেমন হবে যখন আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো, এবং হে মাহবুব, আপনাকে তাদের সবার ব্যাপারে সাক্ষী ও পর্যবেক্ষণকারীস্বরূপ উপস্থিত করবো?” [সূরা নিসা, ৪১]; আর ২য়টি এরশাদ করে - “এবং কথা হলো এ রকম যে আমি (আল্লাহ) তোমাদেরকে (মুসলমানদেরকে) সব (নবীগণের) উম্মতের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি যাতে তোমরা মানব জাতির ব্যাপারে সাক্ষী হও। আর রাসূলে খোদা (দ:) হন তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষী”[সূরা বাকারা, ১৪৩]। মহানবী (দ:) যা জানেন না বা দেখেন নি সে সম্পর্কে তো তাঁকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে বলা হবে না।

ওপরের এই প্রমাণ মহানবী (দ:)-এর বিশুদ্ধ হাদীস বা বাণী দ্বারা সমর্থিত যা বর্ণনা করেছেন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) সহীহ, সুনান ও মাসানিদ গ্রন্থগুলোতে:

হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, “নূহ (আ:) ও তাঁর কওম (জাতি) আসবেন (বর্ণনান্তরে তাদেরকে ‘আনা হবে’) এবং আল্লাহতা’লা তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কি আমার ঐশী বাণী (ওদেরকে) পৌঁছে দিয়েছিলে?’ তিনি উত্তর দেবেন, ‘জ্বি, পৌঁছে দিয়েছিলাম, হে মহান প্রতিপালক।’ অতঃপর তিনি ওই উম্মতকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘(আমার বাণী) কি তিনি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন?’ আর তারা বলবে, ‘না, কোনো নবী আমাদের কাছে আসেন নি।’ এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক হযরত নূহ (আ:)-কে বলবেন, ‘তোমার সাক্ষী কে?’ অতঃপর তিনি উত্তর দেবেন, ‘হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মত।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাক্ষ্য দেবো যে নূহ (আ:) ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, আর এ-ই হলো খোদার বাণীর অর্থ - ‘এবং কথা এই যে আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি ( উম্মাতান ওয়াসাতান বা মর্যাদাবান জাতি হিসেবে) যাতে তোমরা মানব জাতির ব্যাপারে সাক্ষী হও’(২:১৪৩)। আল-ওয়াসাত-এর মানে আল-’আদল তথা ন্যায়বান।” [নোট-২: আল-বুখারী এ হাদীস তিনটি সনদে বর্ণনা করেছেন; এ ছাড়াও তিরমিযী (হাসান সহীহ), এবং ইমাম আহমদ।]


ওপরের বর্ণনার ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) তাঁর ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন যে ইমাম আহমদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণিত একই এসনাদের অনুরূপ আরেকটি রওয়ায়াতে পরিস্ফুট হয় যে (মহানবীর) ওই ধরনের সাক্ষ্য সকল (নবীর) উম্মতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, শুধু নূহ (আ:)-এর জাতির ক্ষেত্রে নয়:

রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “পুনরুত্থান দিবসে কোনো নবী (আ:) (তাঁর উম্মত হিসেবে) একজনকে সাথে নিয়ে আসবেন; আরেকজন দুইজন (উম্মত) নিয়ে আসবেন; অন্যান্য নবী (আ:) আরও বেশি উম্মত আনবেন। তখন প্রত্যেক নবী (আ:)-এর উম্মতদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘এই নবী (আ:) কি তোমাদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন?’ তারা উত্তর দেবে, ‘না।’ অতঃপর ওই নবী (আ:)-কে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘আপনি কি আপনার উম্মতের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন?’ তিনি বলবেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘আপনার সাক্ষী কে?’ তিনি উত্তর দেবেন, ‘মহানবী (দ:) ও তাঁর উম্মত।’ এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) ও তাঁর উম্মতকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘এই নবী (আ:) কি তাঁর উম্মতের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন?’ উম্মতে মোহাম্মদী উত্তর দেবেন, ‘হ্যাঁ।’ তাঁদেরকে প্রশ্ন করা হবে, ‘তোমরা কীভাবে জানো?’ তাঁরা বলবেন, ‘আমাদের মহানবী (আ:) এসে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে আম্বিয়া (আ:) তাঁদের উম্মতদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন।’ আর এটাই হলো ওই খোদায়ী কালামের অর্থ যা’তে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি (আল্লাহ) তোমাদের ( মুসলমানদের)-কে সকল উম্মতের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি যাতে তোমরা সমগ্র মানবজাতির ব্যাপারে সাক্ষী হতে পারো এবং মহানবী (দ:)-ও তোমাদের পক্ষে সাক্ষী থাকেন’ (আল-কুরআন, ২:১৪৩)। এই শ্রেষ্ঠত্ব বলতে আল্লাহ বুঝিয়েছেন ন্যায়পরায়ণতাকে (ইয়াকুলু আদলান্)।”

মোল্লা আলী কারী ‘মেশকাতুল মাসাবিহ’ গ্রন্থে হযরত নূহ (আ:)-এর উল্লেখিত ওই বর্ণনার ব্যাখ্যায় বলেন:

”আর তিনি (নূহ আলাইহিস সালাম) জবাব দেবেন, ‘মহানবী (দ:) ও তাঁর উম্মত’; অর্থাৎ, উম্মতে মোহাম্মদী হবেন সাক্ষী এবং রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদের (সত্যবাদিতার) পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। তবে তাঁর নাম মোবারক প্রথমে উচ্চারিত হওয়াটা সম্মানার্থে (লিত্ তা’যিম)। এটা সম্ভব যে তিনি নিজেও হযরত নূহ (আ:)-এর পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন, কেননা এর প্রেক্ষিত হচ্ছে সাহায্য করার; আর আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, ‘যখন আল্লাহ তাঁর আম্বিয়া (অ:)-দের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন’, এবং [মহানবী (দ:) সম্পর্কে] তিনি আয়াতের শেষে বলেন, ‘তোমরা (আম্বিয়াবৃন্দ) তাঁর প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁকে সাহায্য করবে’ (আল-কুরআন, ৩:৮১)। এই বিষয়ে লক্ষ্য করার মতো হঁশিয়ারি আছে এই মর্মে যে, যখন আম্বিয়া (আ:)-দেরকে ও তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথমে হযরত নূহ (আ:)-কে ডাকা হবে এবং তাঁদের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে এই উম্মত (-এ-মোহাম্মদীয়া)-কে পেশ করা হবে, তখন রাসূলে পাক (দ:) ওই চূড়ান্ত বিচারালয়ে উপস্থিত থাকবেন ও সাক্ষ্য দেবেন (ওয়া ফীহি তাম্বিহুন নাবিহুন আন্নাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামা হাযিরুন নাযিরুন ফী যালিকাল আরদিল আকবর )।” [নোট-৩: মোল্লা কারী কৃত ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’, দারুল ফিকর ১৯৯৪ সংস্করণ ৯:৪৯৩=এমদাদিয়া মুলতান (পাকিস্তান) সংস্করণ ১০:২৬৩-২৬৪=কায়রো ১৮৯২ সংস্করণ ৫:২৪৫]

কুরআন মজীদে অন্যান্য আয়াত আছে যা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে হুযূর পূর নূর (দ:) মানুষের আমল (কর্ম) দেখেন এবং শোনেন। আল্লাহ এরশাদ ফরমান: “এবং জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (দ:) রয়েছেন” (আল-কুরআন ৪৯:৭)। “অতঃপর তোমাদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করবেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)” [ওয়া সাএয়ারাল্লাহু আমালাকুম ওয়া রাসূলুহু - আল্ কুরআন ৯:৯৪]  এবং “আপনি বলুন: কাজ করো; অতঃপর তোমাদের কাজ প্রত্যক্ষ করবেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) এবং মো’মেন মুসলমানবৃন্দ” (আল-কুরআন ৯:১০৫) -- ওপরের এই আয়াতগুলোতে রাসূলে পাক (দ:)-এর দর্শনক্ষমতাকে একদিকে মহান রাব্বুল আলামীনের দর্শনক্ষমতার সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে, যে মহান স্রষ্টার দর্শনক্ষমতা সব কিছুকেই বেষ্টন করে রেখেছে, আর অপর দিকে, সকল জীবিত মো’মেন তথা বিশ্বাসী মুসলমানের দৃষ্টিশক্তির সাথেও বর্ণনা করা হয়েছে।

শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ আল-গোমারী বলেন:

”আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারবৃন্দ! আল্লাহকে ভয় করো এবং ত্যাগ করো যা অবশিষ্ট রয়েছে সুদের (প্রথার), যদি মুসলমান হও। অতঃপর যদি তোমরা এই আজ্ঞানুরূপ না করো, তবে নিশ্চিত বিশ্বাস রেখো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে (তোমাদের) যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে’(আল-কুরআন ২:২৭৮-৯)। এই আয়াতে করীমা ইঙ্গিত করে যে মহানবী (দ:) তাঁর মোবারক রওযায় জীবিত আছেন এবং তাঁর দোয়া দ্বারা সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন (অর্থাৎ, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন); অথবা তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন কবর-জীবনের সাথে খাপ খায় এমন যে কোনো ব্যবস্থা (অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা) দ্বারা ওই পাপীদের শাস্তি দিচ্ছেন। এই আয়াত হতে আমি যে সিদ্ধান্ত টানলাম, আমার আগে এই রকম সিদ্ধান্ত কেউ টেনেছেন বলে আমার জানা নেই।” [নোট-৪: আল-গোমারী কৃত ‘খাওয়াতিরে দিনিইয়্যা (১:১৯)।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন