শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৪

Hajir najir bye kazi bhai 5

অপর দিকে, ‘আল-হাযির’ শব্দটি নিরুদ্ধ, কেননা আরবী ভাষায় এটি কোনো স্থানে শারীরিকভাবে উপস্থিত হওয়াকে বোঝায়। অর্থাৎ, এটি সৃষ্টিকুলের এমন এক বৈশিষ্ট্য যা স্রষ্টা হতে নিরুদ্ধ। সুতরাং ‘হাযের’ শব্দটি ’সর্বত্র উপস্থিত’ শব্দটির মতোই আল্লাহর ক্ষেত্রে কেবল আলঙ্কারিকভাবে ব্যবহার করা যায়, যাতে বোঝানো যায় যে তিনি সর্বজ্ঞানী; কিন্তু আল-কুরআন, সুন্নাহ কিংবা প্রাথমিক জমানার ইমামবৃন্দের লেখনীর কোথাও ‘সর্বত্র উপস্থিত’ বা ‘হাযের’ হওয়াকে খোদায়ী গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ বা বর্ণনা করা হয় নি। আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ওপরে উক্ত আপত্তি উত্থাপনকারীর কাছে যখন এ খণ্ডনমূলক বক্তব্যের কিছু কিছু পেশ করা হয়, তখন সে বলে: “হাযের ও নাযের বলতে আমরা বোঝাই আল্লাহর জ্ঞান সম্পূর্ণ ও সামগ্রিক। তাঁর সম্পূর্ণ জ্ঞান হতে কোনো কিছু আড়ালে নয়। আরেক কথায়, তিনি হলেন ‘আলীম’ এবং তাঁর এই সিফাত আল-কুরআনে বার বার উল্লেখিত হয়েছে।” ওই আপত্তি উত্থাপনকারী এ জবাব দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছে:

. সে ‘আলীম’ বোঝাতে ‘হাযের’ ও ‘নাযের’ শব্দ দুটোকে আলঙ্কারিকভাবে ব্যবহার করেছে;
. নিজের কৃত ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রথমোক্ত শব্দটি দ্বারা শেষোক্ত দুটো শব্দ বোঝাতে গিয়ে সে যেমন (ক) ভাষাতত্ত্ব/বিদ্যার ওপর নির্ভর করে নি, তেমনি (খ) ’নস-এ-শরঈ’ তথা শরীয়তের দলিলের ওপর নির্ভরও করে নি।

আমরা শায়খ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহ:)-এর “আল্লাহ হাযের ও নাযের” মর্মে বক্তব্যের প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাচ্ছি; তাতে কিছু শর্তও প্রযোজ্য:


/ -- খোদায়ী নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের মৌলিক নিয়ম-কানুন, যা ’আল-আসমা’ ওয়াস্ সিফাত’-বিষয়ক সালাফ-এ-সালেহীন (প্রাথমিক যমানার বুযূর্গ উলামা) ও খালাফ-এ-সোয়াদেকীন (পরবর্তী যুগের বুযূর্গ উলামা)-বৃন্দের ওপরে বর্ণিত নীতিমালার আলোকে প্রণীত, তা নাকচ করতে কোনো বিচ্ছিন্ন মন্তব্যকে ব্যবহার করা যাবে না।

/ -- বাস্তবতার আলোকে, শায়খ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহ:) তাঁর বক্তব্যকে যত্নসহ এমনভাবে সাজিয়েছেন যা নকশবন্দিয়া তরীকার আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার আওতাধীন কোনো খালেস (একনিষ্ঠ) মুরীদের খোদায়ী জ্ঞানের সর্বব্যাপী প্রকৃতি-বিষয়ক সচেতনতাকে দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করে; ঠিক যেমনি শাযিলী তরীকার পীরেরা তাঁদের মুরীদানকে বলতে শেখান “আল্লাহু হাযিরি”, ”আল্লাহু নাযিরি”, ”আল্লাহু মাঈ”। এই সকল অভিব্যক্তি বা প্রকাশভঙ্গি খোদাতা’লা সম্পর্কে গভীর সচেতনতাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই; আর প্রকৃতপক্ষে এগুলোর সবই ঐশী জ্ঞানের এমন বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি দিকনির্দেশ করে যা সৃষ্টিকুলের ‘হুযুর’ বা ’নযর’-এর সাথে কোনো রকম সাদৃশ্য রাখে না, কেবল নামের সাযুজ্য ছাড়া।

/ -- তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ্ থেকে, আরবী ভাষায় এবং মহানবী (দ:)-এর সম্পর্কে যাঁরা ‘হাযের’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তাঁদের থেকে আলাদা কোনো কিছুকে বুঝিয়েছেন শায়খ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহ:)। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ‘হাযের’ বলতে স্বাভাবিক সৃষ্টিজাত ‘উপস্থিতির’ অর্থে বোঝান নি, বরং তিনি একে ‘আল-এলম আল-হুযূরি’ তথা ঐশী জ্ঞানের অ-সৃষ্টিজাত অর্থে বুঝিয়েছেন। এটা তিনি ‘মকতুবাত শরীফ’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে শাহজাদা খাজা মোহাম্মদ সাঈদকে লেখা ৪৮নং চিঠি, যার শিরোনাম ’খোদার নৈকট্যের রহস্য ও তাঁর যাত মোবারক সম্পর্কে আত্মপ্রকাশ’, তাতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। এটা একটা অতি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও বিশেষায়িত অর্থ যাকে এই দৃষ্টিকোণ্ থেকেই দেখতে হবে, যদি না কেউ শায়খ সেরহিন্দী যে অর্থে বুঝিয়েছেন তার পরিপন্থী কোনো মানে বের করতে আগ্রহী হয়।

/ -- ’মুফতী’ খেতাবে পরিচিত আমাদের সমসাময়িক কতিপয় ব্যক্তি আকিদাগত কোনো বিষয়ে শর্তারোপের সময় নতুনত্বের সাথে এই একই বাক্য ব্যবহার করে থাকেন, যার ফলে তাদের দ্বারা ওই বাক্যের ব্যবহারের মানে কী তা নিয়ে যৌক্তিক সংশয় দেখা দেয়; এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যখন তারা এর সাথে যোগ করেন (নিজেদের) বানানো শর্ত, যথা - “আল্লাহর ছাড়া আর কারো প্রতি ‘হাযের’ ও ’নাযের’ শব্দগুলো প্রয়োগ করা যাবে না।” এ কথা বলে তারা বিচারকের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তটি বাতিল করে দিয়েছেন যা দ্বারা তিনি যে কোনো এবং যে সকল মামলায় সাক্ষী গ্রহণের দরকার সেগুলোতে সাক্ষী নিতে না পারেন। বরঞ্চ তারা (হয়তো) বোঝাতে চান, “আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি সেই অর্থে এটি আরোপ করা যাবে যে অর্থে আল্লাহর প্রতি আরোপ করা হয়েছে”, যখন (আদতে) তা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদের প্রতিও আরোপ করা যায় মাখলুক তথা সৃষ্টির প্রতি আরোপযোগ্য অর্থে।


/ -- সৃষ্টিকুল-শ্রেষ্ঠ মহানবী (দ:)-এর প্রতি যাঁরা ‘হাযের’ ও ’নাযের’ শব্দগুলো ব্যবহার করেন, তাঁরা তাঁর সৃষ্টিজাত মহান রূহ বা সত্তাকে আল্লাহ যেখানে চান সেখানে শারীরিক ও আত্মিকভাবে উপস্থিত হওয়ার অর্থে গ্রহণ করেন। আর যারা মহানবী (দ:) এই অর্থে উপস্থিত হতে পারেন মর্মে বিষয়টিকে অস্বীকার করে, তারা ইসলাম ধর্মত্যাগ করেছে।

/ -- মহানবী (দ:)-এর ‘হাযের’ ও ’নাযের’ লকবগুলোর ব্যবহার বাতিলের পক্ষে দলিল হিসেবে বিরোধিতাকারীরা যা পেশ করে থাকে, তার কোনোটাই একে নাকচ করে না। এ লকবগুলো আল্লাহর সাথে তাঁর ভাগাভাগি করা অন্যান্য লকবের মতোই যা আমরা (ইতিপূর্বে) পেশ করেছি; যেমন - আল্লাহ হলেন ‘রউফ’ ও ’রাহীম’, এবং তিনি ‘নূর’ ও ‘শাহীদ’ (সাক্ষী) এবং ‘আল-শাহিদ’ (সাক্ষ্যদাতা)-ও। আর তিনি তাঁরই প্রাক্ অনন্তকালের বাণী আল-কুরআনে এই লকবগুলো রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে দান করেছেন।

/ -- ইসলামী বিদ্বান ব্যক্তিদের উদ্ধৃতির প্রশ্ন উঠলে বিরোধিতাকারীদের উচিত এ কথা স্বীকার করে নেয়া যে ’হাযের’ ও ‘নাযের’ গুণ/বৈশিষ্ট্যগুলো আহলে সুন্নাতের ওপরে উদ্ধৃত মোল্লা আলী কারীর মতো উলামাবৃন্দ আরোপ করেছেন এবং আরও আরোপ করেছেন সে সকল অগণিত আউলিয়া-বুযূর্গ যাঁরা দিন-রাত হুযূর পাক (দ:)-এর (রূহানী) সান্নিধ্যে ছিলেন বলে সর্বজনজ্ঞাত; এঁদের মধ্যে রয়েছেন - শায়খ আবুল আব্বাস আল-মুরসী (রহ:), শায়খ আবুল হাসান শাযিলী (রহ:), শায়খ আব্দুল আযীয দাব্বাগ (রহ:), এবং সম্ভবত শায়খ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহ:) নিজেও (আল্লাহ তাঁদের ভেদের রহস্যকে পবিত্রতা দিন)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন