শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০১৫

মিত্তুর পর কথোপকথন

মৃত্যুর পর কথোপকথন 

ঘটনা – ১

ইমাম বাইহাকী রহ. হযরত সাইদ ইবনুল মুসাইয়্যাব থেকে  বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হযরত উসমান রা. এর সময় যায়েদ ইবনে খারিজা আল-আনসারী রা. ইন্তেকাল  করেন। তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি কথা বলে উঠেন। এবং বলেন, রাসূল স. এর কথা পূর্ববতী আসমানী কিতাবে রয়েছে। আবু বকর সত্য বলেছেন। উমর সত্য বলেছেন। উসমান সত্য বলেছেন।

ঘটনার সনদ বা সূত্র বিশুদ্ধ। দেখুন,

১. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া,  ইবনে কাসীর রহ. খ.৬, পৃ.২৯৩

২.দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী রহ.। হাদীস নং ২৩০৫

৩.আল-ইস্তেয়াব, ইবনে আব্দুল বার রহ. বর্ণনা নং ৮৪৪ ।

৪. ত্ববরানী ফিল কাবীর, বর্ণনা নং ৫১৪৪

৬.তাহজীবুল কামাল।

৭. আস-সিকাত, ইবনে হিব্বান রহ.।

৮. ইমাম আবু হাতিম, মাশাহিরু উলামায়িল আমসার।

 

এছাড়াও বহুগ্রন্থে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনার সনদ সহীহ।  কারামত অস্বীকারকারীদের মতে এটি অসম্ভব। কারামত অস্বীকারকারীরা ফাজায়েলে আমলের এজাতীয় দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত  করার চেষ্টা করেছে। এধরনের ঘটনার কারণে তারা সমাজে জঘন্য অপপ্রচার চালিয়েছে, ফাজায়েলে আমলে কুফুরী-শিরকী বিষয় রয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। নিজেদের বস্তুবাদী বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে কারামতে অবিশ্বাসী হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারাতে মৃত্যুর পরে কথোপকথনের স্পষ্ট ঘটনা রয়েছে। কারামত হিসেবে মৃত্যুর পর কথা বলাতে বিশ্বাস করা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে তাদের দাবী অনুযায়ী পবিত্র কুরআনে কুফুরী-শিরকী বিষয় রয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। একই বিষয় ফাজায়েলে আমলে থাকলে যদি শিরক হয়, তাহলে কুরআনে থাকলে শিরক নয় কেন?

কারামত অস্বীকারকারীরা কি বলতে চায়, কুরআন মানুষকে শিরক শিখিয়েছে? নাউযুবিল্লাহ। তাদের আরেকটি যুক্তি হল, ঘটনার সত্যতা কি? ঘটনা সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সাথে কুফুরী শিরকীর কী সম্পর্ক? বিশুদ্ধ সনদে কুফুরী-শিরকী বর্ণনা করা সঠিক আর দুর্বল সনদে কুফুরী শিরকী বর্ণনা অন্যায়? তাদের দাবী কি এটাই? তারা বলে, কুরআন-হাদীসে থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু একই জিনিস ফাজায়েলে আমলে থাকলে শিরক। এরা আসলে পরোক্ষভাবে কুরআন ও হাদীসে কারামত থাকার কারণে কুরআন-হাদীসকে কুফুরী-শিরকের উৎস বলতে চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভয়ে সেটা প্রকাশ করতে পারে না। নতুবা হুবহু একই বিষয়কে কুফুরী-শিরকের বলার তাৎপর্যটা কী?

ইবনে আব্দুল বার রহ. উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার লিখেছেন,

وهو الذي تكلم بعد الموت لا يختلفون في ذلك

যায়েদ ইবনে খারিজা রা. যিনি মৃত্যুর পর কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ মতবিরোধ করেননি।

 

ঘটনা-২:

ইমাম বাইহাকী রহ. দালাইলুন নুবুওয়াহতে বর্ণনা করেছেন, হযরত রিবয়ী ইবনে খিরাশ বলেন,

“আমার এক ভাই মৃত্যুবরণ করল।  সে আমাদের মাঝে সবচেয়ে দীর্ঘ নামায আদায় করতো। ঘরমের দিনে সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতো।  আমরা তাকে কাপড় আবৃত করলাম। সকলে তার পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ সে চেহারার কাপড় সরিয়ে দিয়ে বলল, আস-সালামু আলাইকুম।  আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ, মৃত্যুর পরেও? সে বলল, আমি আমার প্রভূর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। দয়াময় প্রভূ আমাকে জান্নাত দান করেছেন। তিনি আমার প্রতি রাগান্নিত নন। তিনি আমাকে মণি-মুক্তা খচিত কাপড় পরিধান করিয়েছেন। তোমরা খুব দ্রুত আমাকে রাসূল স. এর কাছে পৌছে দেও। কেননা তিনি আল্লাহর শপথ করেছেন, আমি তার কাছে  না পৌছা পর্যন্ত তিনি স্থান ত্যাগ করবেন  না। ”

ঘটনাটি বিশুদ্ধ সূত্রে রর্ণিত। ঘটনাটি যেসব বিখ্যাতু মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন,

১. ইমাম বাইহাকী, দালাইলুন নুবওয়াহ, খ.৬, পৃ.৪৫৪

২.ইবনে সায়াদ, আত-ত্ববাকাত, খ.৬, পৃ.১৬০।

৩.আল-ইস্তেয়াব, ইবনে আব্দিল বার, যায়েদ ইবনে খারিজা এর জীবনী।

৪.ইবনে আবিদ দুনিয়া, মান আশা বা’দাল মাউত, বর্ণনা নং ৯ ।

৫. ইবনে হিব্বান, আস-সিকাত, খ.৪, পৃ.৩২৬

 

উক্ত ঘটনাটি খুবই আশ্চর্যজনক। এধরনের কোন ঘটনা ফাজায়েলে আমল কিংবা দেওবন্দী কোন আলেমের কিতাবে থাকলে এটা অবশ্যই শিরক হতো। এবং এটা নিয়ে যারপর নাই হাশি-তামাশা করতো কারামত অস্বীকারকারী সালাফী ও আহলে হাদীস। আহলে সুন্নত বহির্ভূত বিকৃত মানসিকতার কিছু শায়খ যেমন, তাউসীফুর রহমান রাশেদী, উমর সিদ্দিক, আবু যায়েদ জমীর, তলিবুর রহমান, মতিউর রহমান মাদানী, মুরাদ বিন আমজাদ, আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালামসহ সালাফী মানহাজ থেকে বিচ্যুত লোকেরা সাধারণ মানুষকে কারামত বিদ্বেষী করছে। আর এভাবেই কুরআন-হাদীস ও সালাফে-সালেহীনের কারামতকে হাশি-তামাশার বস্তু বানিয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। এরা হকপন্থী আলেমদের উপর কুফুরী-শিরকের যতগুলো অপবাদ দিয়েছে, এর অধিকাংশ এজাতীয় কারামত। কারামতকে কুফুরী শিরকী আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি এরা কারামতকে উপহাস করে মূলত: কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে উপহাস করেছে। কারণ যেসব কারামত নিয়ে এরা উপহাস করেছে, হুবহু একই ধরনের কারামত কুরআন-হাদীসে রয়েছে। সুতরাং একটিকে নিয়ে উপহাসের অর্থ একই ধরনের অপরটিকেও উপহাসের পাত্র বানানো। এজন্যই আমরা দেখতে পাই, এদের সামনে কিংবা এদের অনুসারীদের সামনে যখন বিশুদ্ধ সূত্রে এজাতীয় কারামত উল্লেখ করা হয়, তখন নির্দ্বিধায় সেগুলো অস্বীকার করে।

কারামত অস্বীকারের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ও সালাফী মানহাজ বহির্ভূত নব্য মু’তাজিলীদের বাস্তবতা দেখতে এদের লেখা যে কোন বই দেখতে পারেন। বিশেষভাবে আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদিত তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ, মুরাদ বিন আমজাদের লেখা সহীহ আকিদার মানদন্ডে তাবলীগি নেসাব । কারামত অস্বীকার, এগুলো নিয়ে হাশি-তামাশা, একে কুফুরী -শিরকী আখ্যা দেয়ার মাধ্যমে এরা মূলত: বিভ্রান্ত ফেরকা মু’তাজেলাদের  ভ্রান্ত  মতবাদ সমাজে প্রচার করছে। পশ্চিমাদের বস্তুবাদে প্রভাবিত তথাকথিত এসব শায়খদের কিতাব প্রমাণ করছে, পূর্ববর্তী  আলেমগণ ও সালাফের অধিকাংশ  কুফুরী-শিরকী আকিদা লালন করেছেন। নাউযুবিল্লাহ। কেননা, ইতিহাস, তাফসীর, হাদিস, রাবীদের জীবনীর উপর লেখা এমন কোন কিতাব পাওয়া যাবে না যেখানে এধরনের কারামত নেই। সুতরাং এজাতীয় কারামত লেখা, সেগুলো প্রচার করা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে সালাফের কেউ  এই অপবাদ থেকে বাচবেন কি না সন্দেহ। আমরা এধরনের বিকৃত মানসিকতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।

 

উপর্যুক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করার পর ইমাম বাইহাকী রহ. লিখেছেন,

هذا إسناد صحيح، لا يشك حديثيُّ في صحته

অর্থ: ঘটনার সনদ সহীহ। এটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মুহাদ্দিস সন্দেহ করতে পারে না।

 

ঘটনাটি সালাফীদের অনুসরণীয় শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন,

وبالجملة؛ فالقصة صحيحة بلا شك، والله على كل شيء قدير

অর্থ: “মোট কথা, নি:সন্দেহে ঘটনাটি বিশুদ্ধ (সহীহ)। আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান”

[সিলসিলাতুস জয়ীফা,  ৬৬৭৩ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]

 

কারামত অস্বীকারকারীদের বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য একটি পরীক্ষা করতে পারেন। এসব শায়খদের কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, এক দেওবন্দী আলেম উক্ত ঘটনাটি লিখেছেন। এ ঘটনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? কোন কোন কিতাবে আছে, সেটি না বলে এধরনের পরীক্ষা করতে পারেন। তবে যদি বলেন, শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী একে নি:সন্দেহে সত্য বলে স্বীকার করেছেন, তাহলে শায়খদের বুলি পাল্টে যাবে। সুতরাং ঘুণাক্ষরে তাদের সামনে এটা বলা যাবে না।

এধরনের কারামতকে অস্বীকার, একে কুফুরী শিরকী বলার ধৃষ্টতা এ পর্যায়ে পৌছেছে যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত হায়াতুন্নবীর আকিদাকে কুফুরী আকিদা আখ্যা দিচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ। এদের এই তাকফিরী মনোভাব উম্মাহকে বিভক্ত করছে। সাধারণ মানুষকে সরল সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে আলেম বিদ্বেষী করছে। আল্লাহ তায়ালা সাধারণ মানুষকে হেফাজত করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন